বাংলাদেশের বন্য প্রানী

হারিয়ে যায়নি আমাদের বনছাগল














কাপ্তাইয়ে বন ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ সফিকুর রহমান ১৯৯৪ সালে আমাকে বলেছিলেন, সেখানকার গহিন অরণ্যে তিনি বনছাগল দেখেছেন। সেবার আমি তাঁর সঙ্গে দুই দিন ঘোরাঘুরি করে চশমাপরা ও রেসাস বানর ছাড়া অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা পাইনি। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে। যতবারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, বনছাগলের খোঁজ নিয়েছি। যখনই তিনি বনছাগল দেখেছেন বা তথ্য পেয়েছেন, আমাকে জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১২-১৩ বার বনছাগল দেখেছেন। কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিলাম, এবার দেখলে যেন ছবি তোলার চেষ্টা করেন। যা হোক, গত এপ্রিলের মাঝামাঝি তাঁর ফোন পেলাম। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই অঞ্চলের গহিন অরণ্যে (সংগত কারণেই জায়গার নাম উল্লেখ করা হলো না) কিছু আদিবাসী দুটি বনছাগলের দেখা পেয়েছিলেন। খবর শুনে তিনিও রওনা হয়ে যান। আদিবাসীরা ভোররাতে পাহাড়ের নিচের দিকে বিচরণরত বনছাগলটিকে তাড়া করেছিল। এতে ছাগলটি খানিকটা আহত হয়েছিল। ততক্ষণে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। ফলে ছাগলটি রক্ষা পায়। বিশ্রাম ও কিছু চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর সেটি নিজে নিজেই পাহাড়ের চূড়ায় হারিয়ে যায়। তিনি আমাকে ই-মেইলের মাধ্যমে বনছাগলটির ছবি পাঠালেন। সফিকুর রহমানের তোলা ছবিটিই আমার মনে হয় দেশের প্রথম কোনো সত্যিকারের বনছাগলের ছবি। এ দেশ থেকে প্রকাশিত বন্য প্রাণীর কোনো বইয়ে এখনো জীবন্ত বনছাগলের ছবি ছাপতে দেখিনি; সবই অঙ্কিত চিত্র।
বনছাগল বা সেরাও (Serow) ছাগল বা অ্যান্টিলোপজাতীয় প্রাণী। এরা পাহাড়ি ছাগল নামেও পরিচিত। নিকটাত্মীয় গরালের (Goral) চেয়ে এরা আকারে বড়। বর্তমানে বিশ্বে ছয় প্রজাতির সেরাও দেখা যায়। এ দেশে এরা Mainland Serow, Asiatic Serow বা Burmese Goat-Antelope নামে পরিচিত। সেরাওয়ের বৈজ্ঞানিক নাম Capricornis sumatraensis.
বনছাগল দেখতে গৃহপালিত রামছাগলের মতো, তবে আকারে বেশ লম্বা। এদের মাথা বড়, মুখ লম্বাটে ও ঘাড় মোটা। কান খাড়া ও ছুচালো দেখতে অনেকটা গাধার কানের মতো। শিং কালো ও পেছনের দিকে বাঁকানো। শিংয়ের ডগা তীক্ষ-সুচালো, ডগাছাড়া বাকি অংশে রিংয়ের মতো দাগ থাকে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের শিং একই রকম ২৩-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। পাগুলো বেশ শক্তপোক্ত। স্ত্রী-পুরুষ বনছাগল দেখতে প্রায় একই রকম। এরা লম্বায় ১.০-১.১ মিটার হয়ে থাকে। ওজনে পুরুষগুলো ৭০-৭৫ ও স্ত্রীগুলো ৫০-৫৫ কেজি হতে পারে। এদের পুরো দেহের পশম রুক্ষ ও মোটামুটিভাবে লম্বা। তবে চুট থেকে ঘাড় পর্যন্ত পশমগুলো তুলনামূলক বেশি লম্বা। গায়ের রং লালচে বাদামি। লেজ দেশি ছাগলের মতোই ছোট, তবে রোমশ। চোখের চারদিকে ও খুরের ওপরের কিছু অংশের পশম সাদাটে। খুরের রং কালো।
বনছাগল অদ্ভুতভাবে পা দুটো ফাঁক করে মাথা নুইয়ে দাঁড়ায়। ভাবখানা এই-যেন এখনই তেড়ে আসবে। সামান্য ভয় পেলেও এভাবে দাঁড়াবে। মাঝে মাঝে সামনের দুই পা তুলে জোরে তা ছুড়ে মারবে মাটিতে এবং নাক ও গলায় কিছুটা হুইসেলের মতো শব্দ তুলে পালিয়ে যাবে। কখনো আবার অক্রমণও করতে পারে। এদের চোখের নিচে এক ধরনের গন্ধগ্রন্থি থাকে, যার মাধ্যমে নিজেদের বিচরণ সীমানা নির্ধারণ করে থাকে।
এরা ঘন ঘাস-লতাপাতাপূর্ণ খাড়া পাথুরে পাহাড়ে বসবাস করে। ভূপৃষ্ঠের ২৭০০ মিটার উঁচুতেও বাস করতে পারে। পাহাড়ের খাড়া ঢালে একাকী ঘুরে বেড়াতে ও খাবার খুঁজতে অভ্যস্ত। সাধারণত, একাকী বিচরণ করলেও অনেক সময় ছোট দলেও থাকতে পারে। সফিকুর রহমান জানিয়েছেন, একবার একটি দলে তিনি সাতটি বনছাগল দেখেছিলেন। এদের চলাচলের পথ এতটাই সরু যে, সেখানে সরীসৃপ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে চলাচল করা বেশ কষ্টসাধ্য। এ দেশে এরা মূলত চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা ও নেত্রকোনার গাড়ো পাহাড়ের গহিন অরণ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে।
ছাগলের মতো বনছাগলও রোমন্থক প্রাণী। কাজেই এরা অন্যান্য রোমন্থক প্রাণীর মতোই তৃণভোজী। সাধারণত, ঘাস, বাঁশের কচিপাতা ও পাথরের গায়ে জন্মানো শেওলা খেয়ে জীবণ ধারণ করে। সাধরণত, সন্ধ্যা ও ভোররাতে খাদ্যের জন্য বিচরণ করে। আর দিনের বেলা জাবর কাটে ও পাহাড়ের চূড়ার কোনো বড় পাথরের আড়ালে বা গুহায় বিশ্রাম নেয়। এরা কোনো কোনো সময় পাহাড়ের চূড়ার এমন জায়গায় বসে থাকে, যেখান থেকে সীমানার চতুর্দিকে চোখ রেখে বিপদ আঁচ করা যায়।
সাধারণত, অক্টোবর-নভেম্তর এদের প্রজননকাল। বনছাগল আট-নয় মাস গর্ভধারণের পর সাধারণত, একটি বাচ্চা প্রসব করে। পাহাড়ের গুহায়, ঘন ঘাসবনে বা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নিজে লুকায় ও বাচ্চা লুকিয়ে রাখে। এরা ঠিক কত বছর বাঁচে সে সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এরা অত্যন্ত বিপন্ন প্রাণী। বনছাগল পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞ সফিকুর রহমানের মতে, এ দেশে বর্তমানে ৫০-৬০টির মতো সেরাও বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই এই অতি বিপন্ন প্রাণীটিকে রক্ষার জন্য এখনই সরকারিভাবে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অন্যথায় অচিরেই হয়তো এরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।                          

আ ন ম আমিনুর রহমান | তারিখ: ২৩-০৫-২০১১
Source: Prothom Alo



চিতা বিড়াল

সৌরভ মাহমুদ | তারিখ: ০১-০৪-২০১১


লাউয়াছড়া অরণ্যে চিতা বিড়াল

ছবি: তানিয়া খান


একসময় গাছপালাসমৃদ্ধ গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলে দেখা গেলেও এখন সংখ্যায় অনেক কমে গেছে। কেবল দেশের বনাঞ্চলে এই চিতা বিড়ালের (Prionailurus bengalensis) সংখ্যা কিছুটা ভালো। ২০০৭ সালে বিড়ালটিকে লাউয়াছড়া বনে দেখি। বছরের প্রথম দিকে লাউয়াছড়া অরণ্যে আবার চিতা বিড়ালের দেখা মিলল। দুপুরের দিকে বিড়ালটি বনের তিন ঘণ্টার ট্রেইলের শেষের দিকে হাঁটাহাঁটি করছিল। স্বভাবে এরা নিশাচর হলেও কখনো কখনো দিনের বেলায় বের হয়। বিশেষ করে নির্জন বনের ছায়ায় কোনো ফাঁকা জায়গায় চোখে পড়ে।
আয়তনে আমাদের পোষা বিড়ালের মতো হলেও পা অনেক লম্বা। পুরো গায়ের রং হলদে, তাতে কালো রঙের অনিয়মিত ছোপ। দেহের নিচের অংশ সাদাটে এবং কালো হালকা বাদামি ফোঁটা আছে। দৈর্ঘ্য ৬৬ সেন্টিমিটার। লেজের দৈর্ঘ্য ২৯ সেন্টিমিটার। প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ালের ওজন তিন-চার কেজি হয়। গ্রামের লোকজন বিড়ালকে চিতা বাঘের ছানা বলে ভুল করে এবং চোখে পড়লে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
প্রজনন সময় ছাড়া বিড়াল একাকী চলাফেরা করে। বড় পোকামাকড়, ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী, ছোট পাখি, খরগোশ, লিজার্ড, কাঁকড়া মাছ ধরে খায়। সুযোগ পেলে বসতবাড়ির হাঁস-মুরগিও শিকার করে।
গাছপালায় আচ্ছাদিত ঘন বন এদের প্রিয় আবাস। বাংলাদেশ বাদে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চীন, রাশিয়া, হিমালয়ের পাদদেশ, জাভা, সুমাত্রা, তাইওয়ান, জাপান ফিলিপাইনে চিতা বিড়াল দেখা যায়।
বসতি ধ্বংস এবং চামড়ার জন্য শিকারের কারণে দেশ থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণীটি