আমিনুর রহমান সুলতান
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতেই একসময় বৈঠকখানা ছিল। এখনও আছে, তবে তুলনামূলকভাবে কম। প্রতিটি সম্পন্ন পরিবারেই বৈঠকখানা ছিল। এবং বৈঠকঘরগুলোতে সৌখিনতার ছাপ ছিল। আমাদের ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে একসময় টিনের ঘরের পাশাপাশি খড়ের ঘরই বেশি ছিল। গ্রামের অপেক্ষাকৃত বেশি জমি টাকা বেশি, এমন ধরনের ধনী যারা তাদের ছিল টিনের বাড়ি। দালান খুব কমই ছিল। সমপ্রতি দালানবাড়ি গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি বাড়ির আঙ্গিনায় সামর্থ্য অনুযায়ী থাকতো একটি বৈঠকখানা। বৈঠকের কাছে থাকতো ছায়াদার কোনো না কোনো গাছ। সেই ছায়ায় থাকতো আবার তক্তা বা বাঁশের তৈরি মাচান। বাড়ির বা পাড়ার যে কেউ বিশ্রাম নেবার জন্য হেলে পড়তো বৈঠকখানার চৌকিতে বা ছায়া ঢাকা মাচানে।
হেমন্তের পাকাধান ঘরে উঠার পর কিছুকাল কাটতো অবসরে। আর ওই অবসর সময়টুকুতে পাড়ার মানুষ মাঠে বা কারও বাড়ির খোলা আঙ্গিনায় আয়োজন করত নাটক মঞ্চায়নের। আর মঞ্চায়নের পূর্বে কারও বাড়ির বৈঠকখানায় রাত বারটা-একটা পর্যন্ত চলত রিহার্সাল। বর্তমানে ওই ধরনের নাটক মঞ্চায়নের জন্য দশ বাড়ি খুঁজেও বৈঠকখানা খুঁজে পাওয়া যাবে না রিহার্সালের জন্য। আত্মীয় সম্পর্কের কোনো মেহমান এলে আগে বসতে দেয়া হতো বৈঠকখানায়। বৈঠকখানার পাশেই থাকত চাপকল বা ইদারা। জলচৌকিতে বসে কাঁসার বদনায় দেয়া পানিতে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রামের জন্যে শুয়ে পড়তেন বৈঠকখানায়। তারপর বাড়ির ভিতরে যাবার পালা। যৌথ পরিবারে একটি বৈঠকখানা থাকত। দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মেহমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠত ওই বৈঠকখানার সংস্কৃতি থেকেই। বৈঠকখানা থাকার কারণেই মেহমানদের একাধিক দিন বেড়ানোর রেওয়াজ ছিল। আড্ডার জন্যে, অবসরে বসে গালগল্প করার জন্যেও বৈঠকখানা পাড়ার বা বাড়ির লোকদের উপযুক্ত জায়গা ছিল। বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের বৈঠকখানার সংস্কৃতি একেক ধরনের। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর অঞ্চলের আমার পরিচিতজন ফারুক খানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বৈঠকখানার সংস্কৃতি নিয়ে। জানতে পারলাম, একসময় ওই অঞ্চলে কাঁসারুরা কাঁসার তৈজসপত্র নিয়ে ফেরি করতে বেরুতো। রাতে কাঁসারুদের আত্মীয়ের মতোই থাকতে দেয়া হতো। খাবারটা তারা নিজেরাই রান্না করে খেতো বটে তবে বৈঠকখানা থাকার কারণে মালসামানা নিয়ে থাকার নিরাপদ আশ্রয় জুটতো। ওই অঞ্চলেও আগের মতো আর বৈঠকখানা নেই বলেও জানালেন তিনি। এতোসব কথা বলার পেছনে শুধু যে নস্টালজিয়া কাজ করছে এমনটি নয়। বর্তমানে অধিকাংশ এলাকায় ও অধিকাংশ বাড়িতে বৈঠকখানা না থাকার কারণেই বৈঠকখানার সংস্কৃতি উঠে যাচ্ছে এই আক্ষেপ থেকেই লেখা।
আমরা সময়ের পরিবর্তনের সাথে রূপান্তর ঘটাচ্ছি আমাদের গ্রামজীবনের ; গ্রামজীবনের আচার- আচরণের। আত্মীয়তার সম্পর্কগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ বলবেন, হয়তো ওই একটিমাত্র বৈঠকখানার জন্যেই কী ওই দূরত্ব সৃষ্টির কারণ। তা অবশ্য নয়। কারণের মধ্যে একটি অবশ্যই। প্রত্যেকটি পরিবারের নিজস্ব একটি 'রাখঢাক' আছে। যাকে আমরা প্রাইভেসি বলি। পলস্নীর ধনী-দরিদ্র সব পরিবারেই প্রাইভেসি রক্ষার একটা ব্যাপার সবসময় ছিলো, এখনও আছে। সেই প্রাইভেসি রক্ষার তাগিদেই অন্দরমহল ও বাহিরবাড়ির মাঝখানে আড়াল ছিলো। বৈঠকখানাগুলো ছিলো অন্দরমহলের বাইরে। বৈঠকখানাকে বাংলাঘর, কাচারিঘর কিংবা বাইর (বাহির) বাড়ির ঘরও বলা হতো।
গ্রামীণ জীবনাচরণে বৈঠকখানার সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে, যা ছিল একান্ত বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ঘরাণা। আমরা কী আবার বাপ-দাদাদের মতো পারি না বৈঠকখানার সংস্কৃতিকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে। বিষয়টি হয়তো সবাইকে ভাবায়। খোঁচা দেয় হয়তো মনের ভিতর।
গ্রামের বৈঠকখানা বর্ষাকালে হাট ফিরতি মানুষেরও আশ্রয়স্থল। শুধু হাট ফিরতি কেনো, হাটে যাবার সময়ও তো। বর্ষাকালে কখন যে আকাশ ফেটে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিয়ে যায় বলা যায় না। হয়তো নামবে নামবে করছে-হাটুরেরাও হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই নেমে গেল। আশপাশে বৈঠকখানা না থাকায় ভিজা কাপড়ে হাট করা বা বাড়ি ফেরার উপায় থাকে না। বৈঠকখানার সংস্কৃতি আমরা ফিরে পাব কিনা জানি না। বিকল্পের সন্ধানে তো আমরা ভাবতে পারি।
[লেখক :কবি, প্রাবন্ধিক]