ভ্রমণ
প্রেম ও প্রকৃতিতে মোড়া জম্মু-কাশ্মীর
অশোককুমার কুণ্ডু
এ বছরের অমরনাথ যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। চলবে অগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই সময় যদি অমরনাথের উদ্দেশে যাত্রা করা যায় তো ‘ডবল মওকা’। প্রথমত, র্তীথ যাত্রা। আর তীর্থে আপত্তি থাকলে কুছ পরোয়া নেই। লক্ষ পূর্ণ্যাথী-মানুষকে তো পাওয়া যাবে এই পথে। তবে নিতান্তই এক ভ্রামণিক হিসেবে যদি ওই পথে পা বাড়ানো যায় তা হলে এই মওকায় জম্মু-কাশ্মীর-অমরনাথ এবং ফেরার পথে বৈষ্ণোদেবী হয়ে ঘরে ফেরা যায়। কম কথা কি! সপ্তাহ দুয়েকের এই ভ্রমণে ধকল ও খরচা অনেক বেশি। তবে হিসেব করলে সফর শেষে কিন্তু পাওয়ানাটাই বেশি। দু’চোখ শুধু নয় দু’কানও টইটুম্বুর হয়ে যাবে। আসলে এই সুযোগে গোটা জম্মু-কাশ্মীরটা যে চষে ফেলা হবে!
জম্মুতে পৌঁছেই আগেভাগে একটা হোটেল ঠিক করে নিতে হবে। তাওয়াই (আঞ্চলিক উচ্চারণে তাওবি) আর চন্দ্রভাগা নদী দু’টি যেন বেড় দিয়ে যুগ্ম করতলে ঘিরে রেখেছে ঐতিহাসিক এই প্রাচীন শহরটিকে। জম্মু— গেটওয়ে অফ কাশ্মীর। তবে ভ্রমণার্থীরা প্রায় সকলেই জম্মুকে ছুঁয়ে পালিয়ে যায় শ্রীনগরে। কী আছে সেখানে? ডাল লেক! তা থাক। জম্মুও কিন্তু কম কিছু না। বিকেলের দিকে ঘন্টা চারেক সময় হাতে রাখলেই শহরের বৈশিষ্ট্যময় জায়গাগুলো ঘুরে নেওয়া যাবে।
আর একটা গোটা দিন যদি রাখা যায়, জম্মুর জন্য, তা হলে শহর থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে তাওয়াই নদীর পাড়ে বালুলোচনের তৈরি বাহু দুর্গ দেখে আসা যায়। তিন হাজার বছরের পুরনো দুর্গ। এ দুর্গ নবম শতকে জম্মুলোচন সংস্কার করেন। অনেকে বলেন এঁর নামেই শহরের নাম। আবার ধর্ম বিশ্বাসী মানুষদের কাছে জম্মুর নামকরণ হয়েছে বীর জাম্বুবানের নামে। ইনি ব্রহ্মার পুত্র, সীতাকে উদ্ধারের জন্য দশ কোটি সৈন্য দিয়ে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেন। এঁরই নামে পীর-খো অঞ্চলে এক গুহার উপরে গড়ে উঠেছে গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়ের মন্দির সঙ্গে বিশাল ধর্মশালা।
বাহু দুর্গ *
রঘুনাথ মন্দির *
যার নামেই হোক না এ শহর, আপনি তো ভ্রামণিক। তবে তথ্যের সূত্রটুকু জানা থাকলে ভ্রমণ হয়ে ওঠে রম্য। বাহু দুর্গের পর রামনগর দুর্গ, ডোগরা আর্ট মিউজিয়াম এবং অমরমহল প্রাসাদ। তার পর জম্মুর ট্যুরিস্ট বাংলোর কাছে শহরের মধ্যমণি রঘুনাথজির মন্দির। এগুলোতে নিজের পছন্দ ও ভাল লাগা অনুযায়ী সময় দিতে হবে।
যাওয়া যেতে পারে ১৯৯২ সালে গড়ে ওঠা ‘গুর্জর সেন্টার ফর কালচার এন্ড হেরিটেজ’-এ। এখানে কিছুটা সময় দিলেই হয়ে যাবে ঘোরার স্বাদবদল। বিশাল এই ক্যাম্পাসে রিসার্চ স্কলারদের কাজের সুযোগ আছে। জম্মুর প্রাচীন এই গুর্জর সম্প্রদায়ের উপর প্রচুর তথ্য মেলে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মতো নাকি লুপ্ত হতে চলেছে এই গোষ্ঠীর ঐতিহ্য।
রঘুনাথ মন্দিরের সঙ্গে বাওয়ে মাতা মন্দির, মহামায়া মন্দির, রানি বীরেশ্বর মন্দির এবং পীর বাবা স্থল ঘুরে নেওয়া যাবে। ধর্মের জন্য নয়, আমি নিজে ঘুরেছি নানা বৈচিত্র্য জানার জন্য। এখানের মানুষ ভিনদেশি ও ভ্রামণিকদের ভালবাসে খুব। কারণটা শুধুই রোজগারের জন্যে নয় বোধ করি!
বাগ-ই-বাহু *
আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকোরিয়াম *
এর পর একটু ভিন্ন স্বাদ। মন্দিরময় জম্মু ছেড়ে এ বার জম্মুরই ‘বাগ-ই-বাহু’তে। একদম ভরপুর সবুজের মধ্যে থেকে দেখতে পাবেন তাওয়াই নদী, আর সঙ্গে শহরের একটি প্রান্ত ও নগরজীবন। বাগ-ই-বাহুর গাছ ও সবুজের মধ্যে ডুবে রয়েছে জম্মু সুন্দরীরা, জোড়ায় জোড়ায়, অনেকটা আমাদের কলকাতার ভিক্টোরিয়ার মতো। বাহু ফোর্টের কাছে এই জায়গাটি সকল সময়ে সুন্দর। এক যাত্রায় ফোর্ট, বাগান এবং পাতালে বিশাল মৎস্যদের বিচরণপাট, অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকোরিয়াম।
এই ফাঁকে জম্মুর দু’তিনটি মেলার খবর দিয়ে রাখি। ‘লহরি’ মেলার সময়টা মধ্য জানুয়ারি। তখন আঞ্চলিক অধিবাসীদের নাচ ‘চাঝা’ দেখতে পাওয়া যায়। বছরে এক বারই হয় এই মেলা। অন্যটি বহুল প্রচারিত মেলা ‘বাহু মেলা’, বছরে দু’বার বসে। বাহু ফোর্টের কালী মন্দির চত্ত্বরে মার্চ-এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। ফেব্রুয়ারি-মার্চের যে মেলা সেটি খুবই বর্ণময়। নাম ‘পূর্ণমণ্ডল মেলা’। তিন দিনের মেলাটি হর-পার্বতির বিবাহ নামে খ্যাত আঞ্চলিক অভিধায়। ‘ঝারি’ মেলার সময় অক্টোবর-নভেম্বর মাস। ঝারি গ্রামেই বসে এই মেলা। এটি আবার জিটু বাবার মেলা নামেও খ্যাত। বাবা জিটু নিজে ছিলেন কৃষক, আর জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে বিদ্রোহ করেন। জম্মু শহর থেকে চোদ্দ কিলোমিটার দূরে ঝারি গ্রামেই ওই কৃষক আন্দোলনের শহীদ স্মরণে এই মেলা। সারা ভারতের মতো জম্মুতেও বসে নওরাত্রির (নবরাত্রি) মেলা। শরতের এই মেলাটি জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি মেলা।
জম্মু থেকে আরও ক’টি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান দেখতে যাওয়া যায়। দূরত্বের বিচারে এগুলি অবশ্যই কিছু দূরে দূরে। জম্মু বা কাটরা থেকে সাতাশি কিলোমিটার দূরে জম্মুর মধ্যে বিখ্যাত ‘গিল রিসর্ট’ পাটনিটপ, প্রায় দু’হাজার ফুট উঁচুতে সুন্দর এই শহর। কাছেই আছে দর্শনীয় নাগ মন্দির। পাটনিটপে সরকারি হোটেল ছাড়াও প্রাইভেট হোটেল/ রিসর্ট আছে। পাটনিটপ আসলে ট্যুরিস্টদের স্বপ্ন-স্থল। তবে জম্মু-কাশ্মীরের বহু দর্শনীয় স্থান কিন্তু সোমবার অথবা শুক্রবার বন্ধ থাকে। কোথাও যাওয়ার আগে এই বন্ধের দিনটা জেনে যাওয়াই ভাল।
জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর যাওয়ার পথে পড়বে উধমপুর, ভারতের শেষ রেলস্টেশন। যদিও রেলমন্ত্রক জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত প্রায় ৩৪৩ কিলোমিটার রেল লিঙ্ক তৈরি করছে। এই রেলের কাজ শেষ হলে এ অঞ্চলের দুর্গমতা অনেকটাই কেটে যাবে। যে উপত্যকায় এই রেল-কর্মকেন্দ্রের মূল স্থল তার নাম বানিহাল। এখানে দাঁড়ালে দেখা যাবে চারদিকে পীরপঞ্জাল পাহাড় আর বরফ। সৌভাগ্যক্রমে এই বানিহালের রেলকর্মীদের সাহায্য পেয়েছিলাম আমার জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণে। ভারতের ভূস্বর্গ— শ্রীনগরের বরফ ছুঁলে ভ্রমণের ভয় ও দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। জম্মু থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব কম-বেশি ৩০০ কিলোমিটার। শ্রীনগরের মায়া কাটিয়ে চারদিক ঘুরে নিতে সময় লাগবে। অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এমন কি ডাল লেকে ভাসন্ত বোটে এক রাত্রির অস্থায়ী সংসারও পাতা যায়। শ্রীনগরকে অনেকে বলেন ‘সিটি অফ ওয়েলথ্ অ্যান্ড বিউটি’! সম্রাট অশোকের কন্যা চারুমতীর আবদারে গড়ে উঠেছিল সে যুগের সুন্দর বিহার। ঝিলম নদী আর ডাল লেকে ঘেরা শ্রীনগরকে অনেকে বলেন ‘ভেনিস অফ দ্য ইস্ট’!
শ্রীনগরে দেখার কী কী আছে? মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের বেগম নুরজাহানের জন্য তৈরি স্মৃতি-উদ্যান শালিমার বাগ। বসন্তে ফুলের জলসা আর সর্বক্ষণের ফোয়ারা-ঝরনায় সাজানো এই মনোরম বাগিচা। শহরের ঈশান কোণে শঙ্করাচার্যের মন্দির, এক্কেবারে পাহাড়ের মাথায়। আদি গুরু শঙ্করাচার্য এখানে আসেন তাঁর বিখ্যাত তীর্থ পর্যটনে। তাঁর তপস্যাস্থল ছোট্ট গুহাটি এখনও আছে মূল মন্দিরের পাশেই।
কাশ্মীরের ‘ওল্ড সিটি’তে বিখ্যাত জামি মসজিদ ও ডাল লেকের পশ্চিমে হজরতবাল মসজিদ দশর্নীয় স্থান। শ্রীনগর থেকে কিছু দূরে পড়বে হারওয়ানা। আগে এখানে ছিল এক বৌদ্ধ বিহার। হারওয়ান গার্ডেনটি পথেই পড়বে।
বেগম নুরজাহানের ভাই আসফ খান ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে গড়েছিলেন নিশাত বাগ। ‘চশমা শাহি’ বা ‘চশমা পানি’ শব্দটি হঠাৎ কানে লাগে ড্রাইভার ওমর ভাইয়ের কথায়। সিরাজবাগ স্থানটি হল নেহরু মেমোরিয়াল বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে। আর চশমা শাহি তৈরি করেন মোগল সম্রাট শাহজাহান, ১৬৩২ সালে। বাগানের ঝরনার জল কাচের মতো স্বচ্ছ। এ জল হজমে সহায়ক। সে কারণেই নাকি এখান থেকে পানীয় জল যেত জওহরলালের জন্য। একই গপ্পো শুনলাম জম্মুতে ফেরার পথে ‘কুদ’ সম্পর্কে। এখানকার মিঠাই বিখ্যাত। সঙ্গে ঝরনার জলও ওই চশমা পানির গল্পের মতো বহতা। সিরাজবাগ কিন্তু অন্য একটি কারণে বিখ্যাত। এখানে লক্ষ রকম টিউলিপ ফোটে বসন্তে। ‘টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল’ হয় ওই সময়ে। জম্মু-কাশ্মীরের ডেপুটি ডিরেক্টর (ট্যুরিজম) অরবিন্দ কোতোয়াল বলেছিলেন, ‘‘বসন্তে টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে আসবেন, দারুণ লাগবে।’’ ইহুদি স্থাপত্যে ছোঁওয়া কাশ্মীরের ‘ওল্ড সিটি’তে ছোট্ট সমাধি মসজিদ রোজাবল রয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীর ভ্রমণে যদি সম্ভব হয় তো অমরনাথ যাত্রা জুড়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে সে যাত্রায় বহু শ্রম এবং বেশি পুণ্য। অমরনাথ যাত্রা সেরে ফেরার পথে বৈষ্ণোদেবী ঘুরে এলে তো কথাই নেই। এত পুণ্য মাথায় সহ্য হলেও পায়ে সহ্য হবে কি না ভেবে দেখতে হবে। কেন না অমরনাথ দর্শন করতে অনেকটা হাঁটতে হয়। অবশ্য পকেটের জোর থাকলে ডাণ্ডি, কাণ্ডি বা ঘোড়ায় যাওয়া যায়। জম্মু থেকে ২৫৫ কিলোমিটার অনন্তনাগ। এখান থেকে পহেলগাঁও ৪৫ কিলোমিটার। পগেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি ১৬ কিলোমিটার। এই সমস্ত পথটাই বাস বা প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়া যাবে। চন্দনবাড়ি থেকে শেষনাগ (১২ কিলোমিটার), শেষনাগ থেকে মহাগুণা হয়ে পঞ্চ তরণী ১১ কিলোমিটার। এর পর তিন কিলোমিটার চড়াই, ব্যস পৌঁছে গেলেন অমরনাথ গুহায়। মোট হাঁটা বা ডাণ্ডি/কাণ্ডির পথ হল ২৬ কিলোমিটার। তবে পথের বৈচিত্র্য এতটাই সুন্দর যা অপূর্ব। বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবেদিতা অমরনাথ দর্শন করেছিলেন এই পথে, পায়ে হেঁটে এবং ওই সময়ে। অমরনাথ থেকে বিবেকানন্দ একা গিয়েছিলেন ক্ষীপ ভবানী মন্দিরে, পায়ে হেঁটেই!
মনে রাখার মতো• বৈষ্ণোদেবী যেতে চাইলে অমরনাথ হয়ে অনন্তনাগ এবং কাটরা হয়ে (পহেলগাঁও থেকে কাটরা ২২৭ কিলোমিটার) ‘জয় মাতা দি’ জয়ধ্বনি দিতে দিতে পৌঁছে যান বৈষ্ণোদেবীর পদতলে, ত্রিকূট পাহাড়ের গুহায়। জম্মু বা কাশ্মীরের মধ্যে ভারতীয় মোবাইল সিম অচল। প্রচুর দালাল সাহায্য করতে চাইলেও ওই ফাঁদে পড়বেন না। কোনও কেনাকাটা, ট্যুর কনডাক্টে অপরিচিত ‘বন্ধুর’ সাহায্য নেবেন না। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ট্যুরিজমের সাহায্য নেবেন:
http://www.jktourism.org
jkdtourism@yahoo.co.in
jaktour@ndf.vsnl.net.in
Subscribe to:
Posts (Atom)
1 comment:
দারুন লাগল পড়ে। বৈষ্ণোদেবী যাত্রার সুবিধার্থে নতুন ট্রেন চালু হয়েছে কাটরা অব্দি; যা ভ্রমণের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করবে।
ভালো থাকবেন।
Post a Comment