চড়ুইভাতির কথা বলার আগে আমাদের দলের সবার পরিচয়টা দেওয়া দরকার। আমি, মেঝো আপা, চাচাত বোন শেফালি, রূপালী, এলিনা, চাচাত ভাই আতিক, সবুজ, রুমানকে নিয়ে আমাদের দল। আমরা স্কুল থেকে এসে বাড়িতে একসাথে খেলাধুলা করতাম। খেলাধুলায় ঝগড়া বাঁধাতে আমরা সবাই পরিপক্ব ছিলাম। একদিন চৈত্রমাসে আমাদের দলনেত্রী মেঝো আপা ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল শুক্রবার চড়-ইভাতির আয়োজন হবে। প্রত্যেককে দুটি করে ডিম, একপট চাল ও প্রয়োজনমতো তেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ও বাকি জিনিস আনতে বললেন। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে আমরা জিনিস নিয়ে পুকুর পাড়ে হাজির হলাম। বলে নেওয়া ভালো যে, আমাদের এলাকায় চড়-ইভাতিকে 'চুলাপাতি' বলা হয়। নতুন চুলা স্থাপন করে পাক করা হয় বলে এ রকম নামকরণ হতে পারে। যা হোক, দলের সবাই আসার পর কোথায় পাক করা হবে সেটা ঠিক করা হয়। মাঠের পূর্বকোণে চুলা স্থাপন করা হয়। চুলা স্থাপন করার জন্য শুধু ইটের প্রয়োজন হয়েছিল। লাকড়ি আনা হলো কারো রান্নাঘর থেকে চুরি করে। রান্না করতে গিয়ে আমাদের দলনেত্রীর চোখের পানি আর নাকের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের কারণে আগুন নিভে যাচ্ছে আর ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে, যার ফলে দলনেত্রীর এই অবস্থা। কোনোক্রমে ভাত রান্না করা হলো। ডিম ভুনা করা হলো। ডাল রান্না করতে গিয়ে মেঝো আপা মনে হয় ভুল করে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে গিয়েছিল। যার ফলে ডালে সাঁতার কাটার মতো পানি দিয়েছেন। রান্না শেষে আমরা খেতে বসলাম। ভাত নয়, মনে হয় চাল খাচ্ছি। ডিমের ভুনাতে বিলাতি মরিচের ঝাল। ডিম খাওয়ার পর সবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে, আমরা যেন মৃতু্য সুরা পান করছি। এলিন খাবার ফেলে দৌড়ে বাড়িতে চলে গেল। আতিক বেচারা ঝালের ধাক্কা সইতে না পেরে বাস্তবেই কান্না শুরু করে দেয়। আমরা বাকি যারা ছিলাম, তারা ঝাল নিবারণের জন্য ডালের সাগরে ডুব দিতে থাকি।
আশরাফুল আলম, জিনারী, হোসেনপুর।
কৈশোর জীবনে চড়-ইভাতি স্মৃতিতে আজও অমস্নান
চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই, আমার কৈশোর জীবনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সুখের ঘটনা। ইচ্ছে করে আবার ফিরে যাই সেইসব দিনগুলোতে। কত হাসি-খুশিতে ভরা ছিল সেইসব অতীত দিনগুলো। কত কথা জমে আছে মনে, লিখতে গেলে পাঠক বন্ধুর পাতায় স্থান হবে না, তবুও সংক্ষেপে দু-একটি কথা প্রিয় পাঠক বন্ধুদের জানাতে চাই। খুব ছোটবেলার কথা, মহলস্নার দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেদের সাথে সঙ্গ দিয়ে বাড়ি থেকে চাল, ডাল ইত্যাদি চুরি করে নির্জন কোনো স্থানে নিয়ে সবাই মিলে রান্না করে খুব মজা করে খেয়েছি। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বকানি খেয়েছি। এটাই হচ্ছে আমার কৈশোরের চড়ুইভাতির স্মৃতি। তা ছাড়াও আরো অনেক স্মৃতির কথা মনে পড়ছে, বাড়ির পাশেই গড়াইনদী, বর্ষার সময় গড়াই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। দেখা যায় প্রচণ্ড স্রোত। স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়াই নদীতে নেমে সাঁতার কেটে, ছোট ছোট মাছ ধরে সময় কাটিয়েছি। মাঝ নদীতে বিশাল চরে উঠে বালি দিয়ে পাহাড় বানিয়ে সময় কাটিয়েছি। বাড়ি ফিরে বড় ভাইয়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছি। কুমারখালী পৌরসভার সামনে বিশাল একটু পুকুর আছে। সবাই বলে গোলাবাড়ি পুকুর। পুকুরের পানি কালো, গভীর। সারা বছর পানি একইরকম থাকে, কমেও না, বাড়েও না। এই পুকুরে সাঁতার কাটতে সবাই ভয় পায়, অথচ আমি এই পুকুরে দীর্ঘ সময় সাঁতার কেটেছি। এক ঘাট থেকে সাঁতার দিয়ে অন্য পাড়ের ঘাটে উঠেছি। এ সবই ছিল কৈশোরের দুরন্তপনা। পড়ালেখার দিকে একদম নজর থাকত না, শুধু দুরন্তপনা করেই ছুটে বেড়িয়েছি। বাড়ি থেকে মার খেয়ে পালিয়ে যেতাম নানা বাড়িতে। নানী আমাকে খুব আদর করত। আমাকে মাঝি ভাই বলে ডাকত। কারণ, আমি ছিলাম ভাইদের মধ্যে মেঝো। সেখানে মাঝি মামাদের একটি ডিঙ্গি নৌকা ছিল, সেটা নিয়ে মামারা পদ্মা নদীতে মাছ ধরত। আমিও সেই নৌকায় করে পদ্মায় যেতাম, বিশাল পদ্মা নদীর প্রচণ্ড ঢেউ, তার মধ্যে বিশাল লম্বা জাল ফেলে বড় বড় মাছ জালে আটকাত। সেসব দিনের স্মৃতির কথা আজও চির অমস্নান হয়ে রয়েছে আমার জীবনে। আমাকে সবচাইতে বেশি আদর করতেন ছোট মামা আনোয়ার হোসেন। তিনি এখন গোপ গ্রাম বাজারে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। আমার প্রিয় নানী আজ বেঁচে নেই। আজ আর নয়, সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
আশরাফুল ইসলাম বকুল, সেরকান্দি, কুমারখালী, কুষ্টিয়া।
কৈশোরের ফেলে আসা দুরন্তপনার দিনগুলো
কৈশোরের দুরন্তপনা এখন শুধুই স্মৃতি। ফেলে আসা দিনগুলো মনে পড়লেই কষ্ট বেড়ে যায়। মনে হয়, যদি সেই অতীতে আবার ফিরে যেতাম। পানগুছি নদীর তীরে আমার কৈশোরের অনেক চড়-ইভাতির স্মৃতি। আমার প্রকাশিত লেখা 'পানগুছির তীর' কবিতা যখন নীরবে আবৃত্তি করি, তখন যেন আমি সেই দুরন্তপনার অতীতে হারিয়ে যাই। আমি চট্টগ্রাম আর ঢাকা শহরে বড় হয়েছি। তবে, মাঝেমধ্যে বাগেরহাটে নিজ জন্মভূমিতে কিছু সময় পার করেছি। দাদুবাড়ি, নানাবাড়ি একই উপজেলার পানগুছি নদীর দুই তীরে অবস্থিত। কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করে তার উপরে চড়ে এবং ভেলার উপরে চড়-ইভাতির আয়োজন করার উদ্যোগ কম করিনি। তবে, ভেলায় চড়েছি, কিন্তু এর উপরে চড়-ইভাতির আয়োজন করে সফল হতে পারিনি। কারণ, ভেলায় নড়াচড়া করলেই মাটির সেই ছোট্ট পাতিল পড়ে যেত। এ ছাড়া আগুন ধরাতেও ব্যর্থ হতাম। আশ্চর্যের বিষয়_ভেলা তৈরি করা, ডাব গাছে ওঠা, বাগিচায় চড়-ইভাতির আয়োজন করার মতো দূরন্তপনায় গাঁয়ের ছেলেদেরকেও হারিয়ে দিতাম। গ্রামের অনেক ছেলেরা তখন এ সমস্ত দুরন্তপনায় ব্যর্থ হতো। শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে গেলে অধিকাংশ দিনগুলো নানাবাড়িতে কাটাতাম। আমার নানারা ছয় ভাই, তাদের বিশাল বাড়ি, বড় রাস্তা থেকে শুরু করে পানগুছি নদী পর্যন্ত শুধু তাদেরই জমি। কৃষিক্ষেত, বাড়ি, বাগিচা সব মিলিয়ে তখন দুরন্তপনার জন্য বড় রাজ্য পেয়েছিলাম। চড়-ইভাতির জন্য মায়ের কাছে যখন যা আবদার করেছি, আমার মা তা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করেছেন। নানাবাড়িতে তখন মামাতো ভাই, খালাতো ভাইদের নিয়ে বিশাল এক কৈশোর রাজ্য। আমার চড়-ইভাতি মাঝেমধ্যে এককভাবেও হতো। ছোট্ট মাটির পাতিলে ভাত রান্না করতাম, বাগানের ভেতর মাটি খুঁড়ে চুলা তৈরি করতাম। আমার নানি দেখে হাসতেন। শুধু এতেই শেষ নয়, বাগানে ঘর তৈরি করতাম। দা হাতে নিয়ে কেটে নিজের ইচ্ছেমতো ঘর তৈরি করতাম। আমার চড়-ইভাতির সাথি ছিল মামাতো বোন মরিয়ম, মাছুমা, মামাতো ভাই তাজুল, জাকির। এ ছাড়া আমার বড় ভাই মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করত। তাজুল, জাকির অধিকাংশ সময় আমার সাথে থাকত। ওরা আমার থেকে বয়সে একটু বড়। একবার নানাবাড়ির বড় বাগিচায় চড়-ইভাতির আয়োজন করলাম। তাজুল ও জাকির আমার সাথে চড়-ইভাতিতে যোগ দিলো। তিনজন মিলে রান্না শুরু করলাম। ওরা দুজন বড় তাই ওরাই চামচ নিয়ে পাতিলে নাড়া দিচ্ছে, তখন আমার খুব হিংসা লাগছিল। আমি বললাম, এখন আমি নাড়া দিব। এ কথা শুনে ওরা হাসতে শুরু করল এবং সেই কথা সবার কাছে প্রচার করেছিল। এক মামাতো বোন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা, তার স্বামীও তখন নাড়া দেওয়ার কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠল বাগিচায়। কৈশোরের সে আনন্দময় চড়-ইভাতি কি আমার কাছে আর ফিরে আসবে?
সাইফুল ইসলাম তানভীর, হাজারীবাড়ী, মহাখালী, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment